ঘুষের টাকা ভাগ হয় প্রতি বৃহস্পতিবার!
ঘুষের টাকা ভাগ হয় প্রতি বৃহস্পতিবার!
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
০৯-১২-২০২৪ ০৯:১৯:৫৮ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
০৯-১২-২০২৪ ০৯:১৯:৫৮ অপরাহ্ন
চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে হবে। তাই খুলনার নিউমার্কেট এলাকার একটি দোকান থেকে অনলাইনে পাসপোর্টের আবেদন করেছিলেন জিনিয়া বেগম (ছদ্মনাম)। পরে পাসপোর্ট অফিসে ফরম জমা দিতে গেলে সেখান থেকে জানানো হয় সার্ভারে সমস্যা, কাগজেও কিছু সমস্যা রয়েছে। বাইরের একটি কম্পিউটারের দোকান থেকে কাগজপত্র ঠিক করে আনতে বলা হয় তাকে। জিনিয়া বেগম পাসপোর্ট অফিসের গেটের সামনে খলিল ফটোস্ট্যাটে গেলে তাকে জানানো হয়, সার্ভারে সমস্যা কয়েকদিনেও ঠিক হবে না। তাকে ‘অন্য লাইনে যেতে হবে’। এই অন্য লাইন মানে ৩ হাজার টাকা দিতে হবে। আড়াই হাজার টাকা বিদেশি সার্ভারে ঢুকতে, বাকি ৫০০ কাগজপত্র ঠিক করতে। অনেক অনুরোধের পর জিনিয়া বেগমের কাছ থেকে আড়াই হাজার টাকা নিয়ে কাজটি করে দিতে রাজি হন কম্পিউটার দোকানের কর্মচারী।
এই নারীর মতো সবাই খুলনা বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিনই হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বাড়তি টাকা দিলেই পাসপোর্ট পেতে তাদের কোনো সমস্যা হয় না। কম্পিউটার দোকানের ছদ্মবেশী কর্মচারী দালালের মাধ্যমে এই ঘুষ নেন খুলনা বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক আবু সাইদ। সপ্তাহে যা টাকা ওঠে, প্রতি বৃহস্পতিবার শতকরা (পার্সেন্টেজ) হিসাবে তা ভাগাভাগি হয়। ভাগের ৭০ শতাংশ পান পরিচালক আবু সাইদ। বাকি ৩০ শতাংশ দালালসহ অফিসের অন্য কর্মচারীরা। এভাবে ঘুষের টাকায় সম্পদের পাহাড় গড়েছেন আবু সাইদ। এরই মধ্যে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাকে তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সূত্র জানায়, গত তিন মাসে খুলনা বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে আবেদন জমা পড়েছে ২৭ হাজার ৬০০টি এবং বিতরণ হয়েছে ২৯ হাজার ৩৪৬টি। কর্মদিবস হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ৩৫০ আবেদন জমা পড়ে। এর একটা বড় অংশই জমা পড়েছে দালালের মাধ্যমে। কালবেলার অনুসন্ধানে দেখা যায়, খুলনা বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের সামনে খলিল ফটোকপি দোকানে খলিলের ছেলে ইমনসহ পাঁচজন দালাল সব থেকে বেশি সক্রিয়। এই দোকানের দোতলায় ফটোস্ট্যাট দোকানে পিয়াল, ফারুক, রাকিব, কালু, জামাল নামে দালাল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পাসপোর্ট অফিস। পাশে মা মাল্টিমিডিয়ায় কালুসহ দুজন দালাল সক্রিয়। বয়রা কলেজ মোড়ে রহিম ফটোকপি। নগরীর বয়রা এলাকায় ইন্ডিয়ান ভিসা অফিসের সামনে গড়ে ওঠা মার্কেটে রয়েছে অন্তত ১০টি কম্পিউটারের দোকান, যারা সরাসরি পাসপোর্ট দালালির সঙ্গে জড়িত। তাদের নেতৃত্বে রয়েছেন মহিউদ্দিন টারজান নামে এক ব্যক্তি। তিনি একাধিকবার আটকও হয়েছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনজন দালালের সঙ্গে কথা হয় কালবেলার। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, গ্রাহক প্রতি ২ হাজার থেকে ৫ হাজার পর্যন্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে। ভেতরে স্যারদের (অফিসের কর্মচারী) ফাইলের (অনলাইন আবেদন) সঙ্গে ১৩শ টাকা জমা দিতে হয়। অফিসে জমা হয় ১২শ টাকা করে। উঠানো টাকা সমন্বয় করেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুন্সি শহীদুল আলম। প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলে জমা হওয়া টাকা পদ অনুযায়ী ভাগ হয়।
এদিকে কালবেলার অনুসন্ধানে জানা যায়, টাকার ভাগ নিয়ে বিভাগীয় অফিসের সাবেক একজন নারী উপপরিচালকের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয় পরিচালক আবু সাইদের। সম্প্রতি ওই নারী উপপরিচালককে এখান থেকে বদলিতে ভূমিকা রাখেন তিনি। এরপর থেকে একাই ঘুষের ৭০ ভাগ টাকা নেন পরিচালক। অন্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বুঝ দেন, এই টাকা সাংবাদিক, প্রশাসন ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও দেওয়া হয়। বাকি ৩০ শতাংশ পান দালাল ও সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা। গত সেপ্টেম্বর মাসে একজন কর্মচারী ১ শতাংশ ভাগ পেয়ে ৪০ হাজার টাকা নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
আবু সাইদের যত সম্পদ: অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৪ সালে সিলেটে সহকারী পরিচালক হিসাবে চাকরির সময় ৫ লাখ টাকাসহ দুদকের হাতে ধরা পড়েছিলেন আবু সাইদ। তিন মাস জেলও খাটেন। এরপর ব্যক্তিগত প্রোফাইল থেকে মামলা ও জেল খাটার তথ্য মুছে পদোন্নতি নিয়ে উপপরিচালক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম পাসপোর্ট অফিসে। সেখানে ই-পাসপোর্টের পরিবর্তে টাকার বিনিময়ে হাজার হাজার এমআরপি দিয়ে গড়েছেন কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ। শুধু এমআরপি থেকেই ২০ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে, যার তদন্ত করছে দুদক। চট্টগ্রামের খুলশী এলাকায় তার তিনটি ফ্ল্যাটের তথ্য পেয়েছে দুদক। এ ছাড়া শহরের দেওয়ানহাটে স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে পোশাক কারখানার অংশীদারত্ব রয়েছে। ঢাকার আগারগাঁওয়ে ৮ তলা বাড়ির তথ্য পেয়েছে দুদক। তার প্রথম স্ত্রী মারা গেলেও তার নামে থাকা বিপুল সম্পদ এবং মেডিকেল ইকুইপমেন্টের ব্যবসা নিজে দেখভাল করলেও তা নিজের নামে না করে মৃত স্ত্রীর নামেই রেখে দিয়েছেন তিনি। তার স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রেশন রয়েছে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের হ্যারিয়ার গাড়ি। তার নামে রেজিস্ট্রেশন রয়েছে দুটি প্রাইভেট কার। আবু সাইদের পৈতৃক বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে আত্মীয়স্বজন, এমনকি কাজের লোকের নামেও জমি কিনেছেন তিনি। শতাধিক বিঘা জমি কিনেছেন শ্বশুরবাড়ি রাজশাহীতে। শ্বশুর, শ্যালক ও শালির নামেও জমি কিনেছেন তিনি।
এ বিষয়ে দুদক কার্যালয়ের খুলনা বিভাগীয় উপপরিচালক মো. আব্দুল ওয়াদুদ কালবেলাকে বলেন, পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক মো. আবু সাইদসহ ওই অফিসের চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত চলছে। এরই মধ্যে একবার তাদের তলব করা হয়েছে। তাদের বক্তব্য শুনেছি। তদন্ত চলমান আছে। শেষ হলে আমরা প্রতিবেদন দেব। এ বিষয়ে এখনই কোনো কথা বলা যাচ্ছে না।
অভিযোগের বিষয়ে খুলনা বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক মো. আবু সাইদ বলেন, আমি কোনো দুর্নীতি করিনি। আমার বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র হয়েছে। সিলেট ও চট্টগ্রামে আমি মাফিয়া বাহিনীর পাসপোর্ট সিন্ডিকেটে বাধা দেওয়ায় আমাকে বিপদে ফেলা হয়েছিল, যা ইতোমধ্যে সমাধান হয়ে গেছে। এ ছাড়া খুলনা পাসপোর্ট অফিসে আমি ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। গ্রাহক হয়রানি বন্ধ করেছি। যেখানে বেলা ৩টায় শত শত লোক থাকত। এখন দেখেন কোনো লোক নেই। মানুষ শান্তিতে কাজ করে চলে যেতে পারছে।
তিনি বলেন, আমি টিভি চালিয়ে কীভাবে ফরম পূরণ করতে হয় ডিসপ্লেতে দিচ্ছি। এ ছাড়া আবেদন জমা নেওয়ার জন্য ডেট দিয়ে হয়রানি করা হতো, আমি বন্ধ করেছি। আর আমার সম্পদের ব্যাপারে যে তথ্য দেওয়া আছে, এসব সত্য নয়। পারিবারিকভাবে আল্লাহ আমাকে কিছু টাকা-পয়সা দিয়েছেন, যার হিসাব কর অফিসে দেওয়া আছে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : News Upload
কমেন্ট বক্স